অনলাইন ডেস্ক: মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের গুরুত্ব দিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু চালু হওয়া এ কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক অভিভাবক বলছেন, নতুন কারিকুলাম চালুর পর স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কোচিংনির্ভরতা বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে অভিভাবকরা এ কারিকুলাম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব রয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন কারিকুলামে দক্ষ করে তুলতে সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আর এ কারিকুলাম বাতিল দাবিতে আন্দোলনের পেছনে রয়েছেন নোট-গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং মালিকরা। যদিও নোট-গাইড প্রকাশকরা বলেছেন, মন্ত্রীর এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল ও পরীক্ষা পদ্ধতি ফের চালুর দাবিতে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামে অভিভাবকদের একটি সংগঠন। অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক অভিভাবক অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিজ্ঞান বা মানবিক বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে তারা উচ্চশিক্ষার বিশেষায়িত বিষয়ে পড়তে গিয়ে নানানভাবে হোঁচট খাবে। এতে উচ্চশিক্ষায় অনেক ছাত্রছাত্রী ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন কারিকুলামে ছাত্রছাত্রীরা কোনো পাঠের তত্ত্বীয় বিষয় বা ব্যাখ্যার ব্যাপারে কিছু শিখছে না, তাদের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইসনির্ভরতা বেড়েছে।

তারা বলেন, নতুন কারিকুলামে সাময়িক পরীক্ষার মতো লিখিত পরীক্ষাও নেই। আছে দলগত কাজ, প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্ট। এগুলো কীভাবে করতে হবে তা ছাত্রছাত্রীরাও বুঝতে পারে না, শিক্ষকরাও বোঝাতে পারেন না। পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারে বাতিল হওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীরা পাঠে মনোযোগ হারাচ্ছে। চালু হওয়া নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের ফলাফল মূল্যায়ন হবে নম্বর বা জিপিএর ভিত্তিতে নয়, চিহ্ন দিয়ে।

ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্তের মাধ্যমে ফলাফল দেওয়া হবে। এসব নিয়মের কারণে শিক্ষার্থীরা হতাশ হচ্ছে, মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ছে। অভিভাবকরা দাবি করেন, চালু হওয়া নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে। ৬০ নম্বরের দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে। ক্লাস টেস্টগুলোয় ৪০ নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন হিসেবে ধরতে হবে।

নবম শ্রেণি থেকে সব শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে চিহ্ন পদ্ধতি ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বাতিল করে নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহ করে তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতে কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।

এ শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে কর্মসূচিও ঘোষণা করেন অভিভাবকরা। গতকালের সংবাদ সম্মেলন থেকে অভিভাবকরা জানান, ১৪ নভেম্বর সারা দেশে অভিভাবক সমাবেশ পালন করা হবে। একই সঙ্গে সারা দেশের জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেবেন তারা। এরপর ২৪ নভেম্বর সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে জাতীয় শহীদ মিনারে অভিভাবক সমাবেশের ডাক দিয়েছেন অভিভাবকরা।

সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবিরের সঞ্চালনায় লেখক ও গবেষক রাখাল রাহা সভাপতিত্ব করেন। এতে অন্য অভিভাবকরা বক্তব্য দেন। কারিকুলাম বাতিল দাবিতে অভিভাবকদের বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান, নোট-গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং মালিকরা এ আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছেন। কারণ এ কারিকুলাম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে তাদের ব্যবসা থাকবে না।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল গতকাল বলেন, ‘এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। আমরা কখনোই সরকারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে নই।’ বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে পড়ুয়া এক ছাত্রের অভিভাবক গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যয় যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে কোচিংনির্ভরতা। শ্রেণিশিক্ষকদের কয়েকজন মিলে গোপনে শিক্ষকের বাসায় কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে কোচিংয়ে অংশ নিতে হয়। কোচিং না করলে নেতিবাচক মূল্যায়ন করা হয়।’ চালু হওয়া নতুন কারিকুলাম নিয়ে স্বস্তিতে নেই শিক্ষকরাও।

রাজধানীর খ্যাতনামা এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ গতকাল প্রতিবেদককে জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করা হয়েছে। এখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কারিকুলাম নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না। এই অধ্যক্ষ দাবি করেন, এ কারিকুলাম ভালো নিঃসন্দেহে। তবে তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা সিংহভাগ শিক্ষকের নেই।

আরও বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে, যেখানে একটি স্কুলে প্রতি শ্রেণিতে শতাধিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে, সেখানে এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের যোগ্যতার অভাব রয়েছে শিক্ষকদের। নতুন কারিকুলামে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষকদের দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।’

– শিক্ষাবার্তা